রাহিন আমিন
Content Warning: This is not an expose article, nor it should be intended as one. TDA, based on the evidences it received, wanted to look beneath the surface and find out what are the actual reasons of teacher harassment incidents all over the country. This article is merely an analysis to the general incidents and is intended to create awareness among the youth.
গ্রুপের নাম ‘সাইবার হাইস্ট’। বিএলএফের কাছে আসা স্ক্রিনশটগুলোর প্রথমটিতেই দেখা গেল সেই গ্রুপের একজন সদস্য বলছেন – তোরা বেশি গ্যাঞ্জাম করিস না। গ্রুপের আরেক সদস্য সেই উপদেশ পুরোপুরি উপেক্ষা করে বললেন, তিনি গালি দিয়ে ‘ফাদায়’ দিতে চান। এরপর মেসেজ ভর্তি বিস্তর গালি লেখে গ্রুপে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন, এটা তার ‘স্ত্রিপ্ট’। গ্রুপের সদস্যদের উদ্দেশ্য, জুম অ্যাপে অনলাইনে ক্লাসে তারা শিক্ষকদের ‘রেইপ’ করবেন!
রীতিমত ছক কেটে, প্ল্যান করে বিভিন্ন শিক্ষককে অনলাইন ক্লাসে হেনস্থা করতে কাজ করেছে এই গ্রুপের অনেক সদস্যরা। এক সুত্রে জানা গেছে, গ্রুপটিতে গভর্নমেন্ট ল্যাব, রাজউক উত্তরা, উদয়নের মতো স্কুলের পাশাপাশি বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্ররাও আছে। তারা সবাই একত্র হয়ে নিজেদের বিভিন্ন ক্লাসের লিংক এই গ্রুপে শেয়ার করে, এবং যখনই সুযোগ পাওয়া যায়, বিভিন্ন শিক্ষকের স্কুল কিংবা কোচিং ক্লাসে ঢুকে তাদের ভাষায় ‘রেইপ’ করার চেষ্টা করে। এই হয়রানি মাইক অন করে গান গাওয়া থেকে অশ্লীল পর্নোগ্রাফিক ছবি পোস্ট করা পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু নিজেরা নয়, তারা তাদের বন্ধুদেরও আহ্বান জানায় এই গ্রুপের অংশ হতে।
গ্রুপটির কিছু স্ক্রিনশট কয়েকদিন আগে হাতে পায় বিএলএফ। এ নিয়ে আমরা কথা বলি সেই গ্রুপের একজন সদস্য মুনতাসির মননের সাথে। মননকে জুনের ২০ তারিখের দিকে এই গ্রুপে অ্যাড দেয়া হয়। মনন জানান, ‘প্রথম দুইদিন আমি খেয়াল করলাম, ওরা বিভিন্ন ক্লাসে শিক্ষকেরা পড়ানোর সময় মাইক অন করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, বা হঠাৎ করেই গান ছেড়ে দিচ্ছে। তখন খুব বেশি পাত্তা দেই নি। গ্রুপ মিউট করে দিয়ে নিজের মতো থাকার চেষ্টা করছিলাম। পাঁচ-ছয় দিন পরে আবার গ্রুপটা চেক করে দেখি ওরা খুবই কনফিডেন্ট হয়ে বিভিন্ন টিচারের ক্লাসে মাইক অন করে গালাগালি করছে, স্ক্রিনে নানা ধরণের আজেবাজে ছবি আঁকছে।’
https://www.facebook.com/theapologuedhaka/posts/1318658088466029
কিন্তু কেন? মনন জানালেন, একই প্রশ্ন তিনিও করেছিলেন। তার সহপাঠীদের সোজাসাপ্টা উত্তরটাও খুব ভদ্র ভাষায় নয়। সেই থেকে বোঝা যায়, গালির পিছে লুকিয়ে খুব কারণটা খুব সহজ। শিক্ষকদের প্রতি অশ্রদ্ধা।
কদিন আগে একই ধরণের অভিযোগে আরেকটি পোস্ট ভাইরাল হয়। মাইলস্টোন কলেজের এক শিক্ষকের অনলাইন ক্লাসে একজন ছাত্র নানাভাবে অপমানের চেষ্টা করে সেই শিক্ষককে। ভেঙচি কেটে, অশ্লীল ভাষায় গান গেয়ে কিংবা গালি দিয়ে নানাভাবে সেই শিক্ষককে অপদস্থ করার চেষ্টা করা হয়েছে লাইভ ক্লাসে। এমন ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, কিংবা শুধু একটি কলেজের ক্লাসেও যে সীমাবদ্ধ নয়, তার প্রমাণ স্ক্রিনশটে উল্লেখিত গ্রুপের সদস্যদের ব্যাকগ্রাউন্ড। দেশের অনেকগুলো নামকরা স্কুল-কলেজের অনলাইন ক্লাসে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে গত দুই মাস ধরেই।
এগুলোকে কী নিছক দুষ্টুমি বলে ধরে নেয়া যায়? বন্ধুদের মধ্যে নানা ধরণের দুষ্টুমি নিয়েও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। দুষ্টুমি তো সবাই করে, নিজেদের স্কুল জীবনে করেছে। নানা ক্লাসে নানা ভাবে নতুন নতুন দুষ্টুমি করার চেষ্টা করে নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু যখন কোনো কিছুর পেছনের কারণটা শুধু-ই শিক্ষকদের অপদস্থ করা হয়, তখন সেটা নিছক দুষ্টুমি বলে মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। মানুষকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে যেকোনো ধরণের হয়রানিকে অপরাধ বলে ধরে নেয়া হয়। অনলাইন ক্লাসে এসব হয়রানির ঘটনাও তাই সাইবার ক্রাইমের মধ্যেই পরে।
যেই পরিমাণ অভিযোগের ব্যাপারে আমরা জানতে পেরেছি, তাতে বোঝা যায়, এমন গ্রুপের সংখ্যা একটি হওয়া সম্ভব নয়। একই ধরণের অভিযোগ এসেছে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে, একই ঘটনার শিকার হয়েছে নটরডেম কলেজের শিক্ষকরাও। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং কলেজের একজন শিক্ষার্থী জানান, কদিন আগে তাদের ক্লাসে ফেইক আইডি দিয়ে একজন ঢুকে সেই ক্লাসের শিক্ষক এবং ছাত্রদের গালিগালাজ করে বের হয়ে যায়। পড়ে তাদের সবাইকে আদেশ দেয়া হয়, ক্লাসের সময় ভিডিও অন করে রাখতে হবে।
ব্যাপারটি শুধু দেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ নয়, কদিন আগে দিল্লী ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষকও এই অভিযোগ করেন। এসব হয়রানি এখন এতটাই প্রচলিত যে বিশ্বব্যাপি এর একটি আলাদা নামও দাঁড়িয়ে গেছে – জুমবোম্বিং।
অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকদের হয়রানি করার যেই ধরণের ট্রেন্ড এখন দেখা যাচ্ছে, তার বেশিরভাগই পরিকল্পিত না হয়ে উপায় নেই। অনলাইন ক্লাস যেই প্ল্যাটফর্মগুলোতে হয়, সেই গুগল মিট কিংবা জুমে সহজেই অনুমতির ভিত্তিতে ছাত্রদের ক্লাসে ঢুকতে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। এবং প্রতিটি প্ল্যাটফর্মেই ক্লাসে ঢুকতে চাওয়া ছাত্রদের পরিচয় চলে যায় শিক্ষকদের কাছে। গুগল মিটে প্রতিটি মেইল অ্যাকাউন্টের আলাদা পারমিশন লাগে। জুমেও ছাত্রদের পরিচয় শিক্ষক কিংবা হোস্ট-এর কাছেই থাকে। তাই নিজের প্রোফাইল দিয়ে এমন করা সম্ভব নয়, তাতে যথেষ্ট শাস্তির ঝুঁকি থাকে।
তাই করতে হয় ফেইক আইডি দিয়ে। ফেইক আইডি ক্লাসে ঢুকানোর জন্য প্রস্তুতি লাগে, কষতে হয় ছক। তার মানে, যারা করছে তারা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই করছে।
তাহলে এসবের সমাধান কী? প্রথমত, শিক্ষকদের এসব পরিস্থিতি কিভাবে সামলাতে হয়, সে ব্যাপারে যথাযথ ট্রেনিং গ্রহণ করতে হবে। অনেক শিক্ষকই এখনো টেকনোলজি বিমুখ মানসিকতা নিয়ে থাকেন। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করতে হলে এসব পরিস্থিতিতে কিভাবে সেই ছাত্রকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া যায়, এসবের ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞান রাখা তাদের প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জুমের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার বদলে গুগল ক্লাসরুম ধরণের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা উচিত, যেখানে শিক্ষকদের নিজেদের ক্লাসের উপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকে। গুগল ক্লাসরুম কিংবা মাইক্রোসফট এডুকেশন ধরণের প্ল্যাটফর্মে এসব হয়রানির সুযোগ কম।
‘শিষ্টাচার’ অনেক ভারি একটা শব্দ। সাধারণত এই শব্দটা আমরা মধ্যবয়স্ক লোকদের ব্যবহার করতে দেখি। এই শব্দের ব্যবহার আমাদের বয়সী তরুণদের থামিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেটা মতামত প্রকাশের সময় হোক, কিংবা গঠনমূলক সমালোচনা করার সময়-ই হোক – প্রায়ই আমরা শুনতে পাই, ‘ভদ্র’ ছেলে কিংবা মেয়েরা বড়দের উপরে কথা বলে না। তাই ভদ্রতা কিংবা শিষ্টাচার ধরণের গুরুগম্ভীর শব্দের সাথে আমাদের প্রজন্মের অনেকের-ই অ্যালার্জি আছে। আমাদেরও আছে। আমরা প্রবীণ প্রজন্মের মতো এই শব্দের যত্রতত্র ব্যবহার করতে চাই না।
কিন্তু শুধু মজার নামে মানুষকে হয়রানি করাও ঠিক নয়। প্রশ্ন জাগে, একেবারে পরিকল্পনা মাফিক শিক্ষকদের হয়রানির চেষ্টা করা এই শিক্ষার্থীরা কি সাধারণ ভদ্রতা কিংবা শিষ্টাচারের ন্যূনতম জ্ঞানটাও ভুলে গেছে?