অরিন হোসেন
একসাথে ২৭টি বই কিনেছিলাম নীলক্ষেতের বিশ টাকার বইয়ের দোকানটি থেকে। প্রতিটি বইয়ের হয় উপরে নাহয় ভেতরের পাতায় লেখা ছিল শেলী । সবগুলো বই-ই ১৯৭৬-১৯৭৮ সালের। ঘরে একাই ছিলো বইটির শেষে স্পষ্ট করে লেখা ছিল পুরো নাম, সেলিমা হোসেন।
বইয়ের প্রথম পাতাগুলোয় সতর্কতা বাণী দেয়া আছে — “PLEASE KEEP OUT OF REACH OF YOUR CHILDREN”। পড়া শুরু করার আগে ভেবেছি, নিষিদ্ধ গল্প নাকি আবার?
এই বইটি যে সময়ের, সে সময় এমন একটি সাহসী প্রচ্ছদ খুব একটা দেখা যেত না। সেই আগ্রহ থেকেই পড়তে শুরু করি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা পায়ে পায়ে প্রতিধ্বনি গল্পটি। অসমাপ্ত এক বাড়ির নতুন করে কাজ দিয়ে শুরু করা গল্পটি খুব সহজেই আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। হিসেবি বড় ভাই শংকর চাটুজ্জে মাত্র বিশ বছর বয়সেই তার বাবাকে বাড়িওয়ালার তীক্ষ্ণ অপমানের বাণে বিদ্ধ হয়ে চোখের সামনে মারা যেতে দেখে। সেই থেকে বাবার নামে একখানা বাড়ি যেন তার ধ্যান জ্ঞান। চারটি ভাইবোনের ভারও তার কাঁধে।
বড় ভাইয়ের স্ত্রী গায়ত্রী দেবী। খুব বেশি একটা নেয়া হয় নি তার নাম৷ তবে এই সংসারে তার প্রবেশের সময় শংকরের চার ভাইবোনকেই নিজের সন্তানের মতো বড় করেছেন৷ বাইশ বছরে বিধবা হয়ে যাওয়া সুবর্ণা নিজেকে দাদার আশ্রিতা মনে করে। তার এই অবস্থার জন্য শংকর দাদার গোঁড়ামি আর স্বার্থপরতাকে দায়ী করে সে। সানু ছিলে মেধাবী ও প্রখর। একমাত্র তাকে নিয়ে সকলের অনেক আশা ছিলে। সদা হাস্যমুখ সেই মানুষটি রাজনীতিতে জড়িয়ে সমাজকে পাল্টে দিতে চেয়েছিল, পারে নি শেষ পর্যন্ত।
শৈশবে মাকে হারানো সমু হঠাৎ করেই যেন বড় হয়ে গেলে। বড় বড় চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে চায়, জানতে চায়৷ তীক্ষ্ণ চোখে এফোড় ওফোড় করে দিতে চায়৷ বাইশ বছরের সমুর পরিবর্তন তার বৌদি সুবর্ণার চোখে পড়ে। বোকা আর ছোট ভাবা সমুকে দিদির শাড়ি বদলানোর সময় স্থির চোখে তাকিয়ে থাকা, সমুর সাথে একই ঘরে থাকায় আপত্তি জানানো দিদি, বৌদিকে নিয়ে কল্পনা করা — সবই প্রথমে নোংরা বলে মনে হতে থাকলেও খানিক পরে নিজেকে শুধরে নিই। উনিশ বছর বয়সী রিনার প্রেমে পড়া, তাদের দুষ্ট চাহনির আদান-প্রদান, দুপুর বেলা সমুকে অবাক করে দিয়ে তার ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরে আসা, দামি এক প্যাকেট সিগারেট, মিষ্টি রোদে তাদের কথোপকথন —তাকে মানতে বাধ্য করল যে এই অনুভূতি বেশ অন্য রকম।
বইটি শেষ করা মাত্র আমার দু’ফোঁটা চোখের পানি শেষ পাতাটি ভিজিয়ে দিল। সেলিমা হোসেনও কি কেঁদেছিল আমার মতো? জানতে ইচ্ছে হয়।
অরিন হোসেন ভালোবাসেন শাড়ি ও শিল্প। অবশ্য শাড়িকেও শিল্প মনে হয় তার। বাঙালি ঐতিহ্যকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জীবনের একটি অংশে পরিণত করার তাড়না বোধ করেন নিজের মাঝে।