ফারদিন হাসান
“মানুষ বড়ই আজব কিসিমের প্রাণী। বিশেষ করে সাহিত্য জগতের মানুষগুলো। সবকিছুতে ট্র্যাজেডি বের করে সেটির নাম দেয় ‘আর্ট’ ৷ আরে ব্যাটা, তোরা আর্টের বুঝিসটা কী?”
খাঁচার মতো দেখতে রেলিংটা বেয়ে তার উপর উঠে বসে প্রমাকে টেনে তুললাম। বোম্বে সুইটসের পটেটো ক্র্যাকার্স খেতে খেতে আবার বাণী শুরু করলাম, “তো কী বলছিলাম জানি? ওহ হ্যাঁ, এরা আর্টের কী বুঝে? না, ঠিক আছে, আমি নিজেই না হয় কিছুই জানি না। কিন্তু ট্র্যাজিক বিউটির নামে শহরটিকে যে মধ্যরাতে নেক্রোপলিস বলে পরিচয় দেয়, সেটা কীরকম নোংরামো? যেই শহরে রাত ২ টায় পটেটো ক্র্যকার্স পাওয়া যায়—তাও আবার যেন তেন পটেটো ক্র্যাকার্স না, বরং বোম্বে সুইটসের পার্ফেক্টটা—যেটা কেনার সময় এই রাত বিরাতে মামা অন্যরকম সুন্দর একটা হাসি দেয়, আর যেটা কি না খাওয়া যায় মানুষের বাসার রেলিংয়ের উপর বসে পা ঝুলিয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে, সেই শহরটাকে নিজের সাহিত্যের স্বার্থে নেক্রোপলিস বলা শুধু স্বার্থপরতা নয়, বরং ঘোরতর অপরাধ।”
আমার কথা শুনতে শুনতে আধা বোতল স্টারশিপ শেষ করে মুচকি হেসে সে বলল, “আর তুমি যে আর্টের নামে এত প্যাশনেটভাবে অ্যাগ্রেশন ঝাড়ো, সেটা কী?”
আমার সাথে থেকে থেকে আমার প্যাটার্ন ধীরে ধীরে বুঝে যাচ্ছে প্রমা, এটা ভেবে ভালোই লাগল। মানুষের কাউকে বোঝার চেষ্টা করাই আমার চোখে ভালবাসা। আর তাতে কিছু অংশ সফল হলে ব্যাপারটিকে ম্যাজিকাল বলা যায়। যদিও পুরোপুরি কাউকে বোঝা যায় না, কিন্তু অনেকটা যদি বুঝে যাওয়া হয় তবে সেটি বোরিং হয়ে যায়। কেননা, ইলিমেন্ট অফ সার্প্রাইজ না থাকলে কোনো কিছুই দিন শেষে জমে না। তবে মানুষ সেক্ষেত্রে কিছুটা সৌভাগ্যবান, প্রতিদিন নতুন জিনিস সহজে এডপ্ট করে চমকে দিতে তারা বেশ ভালোই পারে।
“কী মশাই? ধরা খেয়ে চুপ করে গেলেন বুঝি?” বলে হেসে উঠল প্রমা। একটি ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে আমিও বললাম, “না, আসলে এই প্যাশনেট অ্যাগ্রেশন ব্যাপারটি যেমন ভাবছ, ঠিক তেমন না, এর আরেকটু গভীর ধারণা আছে আমার।”
প্রমার হাত থেকে স্টারশিপটা নিয়ে একটি চুমুক দিয়ে বললাম, “আসলে, আমাদের জনগণ বিপ্লব করা ভুলে গেছে৷ কিছু নিয়ে আগুন লাগলে তা বড়জোর ৫ দিন টিকে, এরপর ফু-উ-উ-শ। এদের মধ্যে অ্যাগ্রেশন আনতে হবে। দেখো, সাহিত্যের চেয়ে বড় কোনো মাধ্যম নেই মানুষকে ধীরে ধীরে কিন্তু গভীরভাবে প্রভাবিত করার। একটি বই, একটি লেখনী পারে ইতিহাসকে বদলে দিতে, মানুষকে নতুন ভাবে ভাবাতে৷ এখন পর্যন্ত যত বিপ্লব হয়েছে, সবখানে তোমার বলা প্যাশনেট অ্যাগ্রেশন ছিল এবং ছিল বলেই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। আমি হয়তো সেটি জাগাতে পারব কিংবা পারব না, কিন্তু অন্তত বীজটা বুনে যাবোই, ইনশা-আল্লাহ।”
“ওই রেলিংয়ের উপর কে রে?” ডাকের সাথে সাথে একটা টর্চলাইটের আলো গায়ে পড়ল৷ দেখি, কুকুর নিয়ে দারোয়ান চাচা ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। লাফ দিয়ে রেলিং থেকে নেমে প্রমার হাত ধরে দিলাম দৌঁড়। পিছন থেকে “চোর! চোর!” বলে একটা ধ্বনি কানে ভেসে এল, কিন্তু ততক্ষণে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি।
তাড়াহুড়ো করে একটা সিএনজিতে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “কোন দিন যে এসব করতে যেয়ে ধরা পড়ি আর কারো খুন করে পালিয়ে আসি কে জানে?” প্রমা হেসে বলল, “হ্যাঁ, এরপর ফাঁসিতে ঝুলতে হবে তোমাকে।”
একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, “আচ্ছা, ধরো একদিন খুন করেই বসলাম, একমাত্র সাক্ষী তুমি, কোনো প্রমাণ নেই আর কেইস কোর্টে উঠল। তখন তুমি কী করবে?”
প্রমা আমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “যদি এরকম আদৌ কোন দিন হয় তাহলে আমি কোর্টে মিথ্যা বলে তোমাকে বাঁচাব না এইটুকু তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। কিন্তু জেইলে যেয়ে তোমাকে নিজ হাতে ভাত খাইয়ে আসব।”
আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম। মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবলাম, এসব বিপ্লব-জাস্টিফিকেশনের আলাপ ওর মাথায় ঢুকিয়ে আমি কি নিজের কপালে নিজেই শনি ডেকে আনলাম?