ফিরিঙ্গিয়া

Editor
5 Min Read

মুহাইমিনুল নাফিউ


স্বচ্ছ নীল পানিতে সাদা মেঘের প্রতিচ্ছবি। মাঝে মাঝে দুই একটা বজরা শান্ত পানি কেটে চলে যাচ্ছে। দুপুরের কাঠফাটা রোদ থেকে বাঁচতে নদীর পাশের বিশাল এক গাছের ছায়ায় বসে আছে সে৷ তার বিশাল দেহ থেকে ঘাম ঝরছে। সেদিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। মন, আবেগ — কোনোটিই তার কখনো ছিল না। লোকে তাকে ডাকে ফিরিঙ্গিয়া নামে। তার বিশাল শক্তসমর্থ দেহ আর গায়ের রঙের কারণে এই নাম। তার আসল নাম সে নিজেও ভুলে গেছে। ফিরিঙ্গিয়াই তার পরিচয়। ঠগীদলের প্রধান সে। কখনো কি অন্য কিছু হতে পারত সে? ঠগী না হয়ে কি কোনো এক নিরীহ গেরস্ত হতে পারত না? ভাবনায় ছেদ পড়ল ভারি গলায়, “ওরা প্রায় এসে গেছে, এখন কী করব?”

উঠে বসল ফিরিঙ্গিয়া। দুইদিন ধরে তারা এই বটতলায় বসে আছে। অবশেষে এসেছে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী। পেছনে জমিদারের একমাত্র মেয়ে। পশ্চিমে যাচ্ছে ওরা, সাথে রূপা-জহরত। এখন এদের সাথে মিশে যেতে হবে। তারপর সময়মতো ঝিরণী উঠবে।

লাঠিয়াল বাহিনী কাছাকাছি আসতেই ফিরিঙ্গিয়া এগিয়ে লাঠিয়াল বাহিনীকে থামতে অনুরোধ করল।আপনারা কি পশ্চিমে যাচ্ছেন? আমরাও পশ্চিমেই যাচ্ছি। আমরা তো প্রায় শ’খানেক মানুষ, আর আপনারা মাত্র ছয়-সাত জন। রাস্তায় বিপদ-আপদ তো কম নয়, আমাদের সাথেই চলুন না হয়। একসাথে থাকলে বিপদ আপদ একসাথে ঠেকানো যাবে।”

লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান হরিশ এত মানুষ দেখে একটু ভরসা পেল। পশ্চিমে যেতে যে জঙ্গলাকীর্ণ পথ পড়ে, সেটা মাত্র চারজন লাঠিয়াল নিয়ে পার হওয়াটা মোটেই সুবিধার নয়। তোমরা সবাই এক সাথে?” মাথা চুলকে ফিরিঙ্গিয়া উত্তর দিল, “না, হুজুর। এরাও আপনাদের মতোই মুসাফির। প্রায় ন-দশ খানা দল আছে এখানে। সবার সাথেই পথে মোলাকাত।” হরিশ আর ভাবনা-চিন্তায় গেল না। পালকির কাছে গিয়ে পর্দা তুলে জমিদার কন্যাকে বলল, “আমরা এখানে থামছি।”

জমিদারের মেয়ের বয়স ছয়৷ জমিদার মারা গেছেন গত সপ্তাহে। মেয়েকে এই জংলার মধ্য দিয়ে মায়ের বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। জমিদার আর তার বউয়ের বনিবনা ছিল না, বাপের অনাদর আর মায়ের অনুপস্থিতিতে বেড়ে উঠা এই মেয়ের কাছের কেউ থাকলে এই হরিশই। মেয়েকে মায়ের বাড়ি পাঠানোর উদ্দেশ্য ওকে জমিদারের ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচানো। এজন্যই এই বিরান পথে ক্লান্তিহীন যাত্রা। গল্পের প্রয়োজনে মেয়ের নাম ধরে নিচ্ছি নবণী। 

নবণীর ফিরিঙ্গিয়াদের সাথে মিশে যেতে বেশি সময় লাগল না। এত মানুষের মাঝে হরিশও একটু স্বস্তি অনুভব করছে। দুদিন হলো তারা একসাথে পথ চলছে। প্রথম প্রথম কিছু সন্দেহ থাকলেও এখন কোনো সন্দেহ নেই। নবণী তো এখন পালকিতেও থাকে না। ওকে পাওয়া যায় ফিরিঙ্গিয়ার কোলে। ফিরিঙ্গিয়া ওকে গল্প বলে। পক্ষীরাজের গল্প, দেবতাদের গল্প, রাজা-রাণীর গল্প।

নবণী আদুরে গলায় বলে, যাহ্। তুমি গুল মারছ, কাকা।”

“আরেহ না, মা। সত্যি বলছি, ভবানীর কসম।”

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।”

বিশ্বাস করি না কথাটা ফিরিঙ্গিয়ার কাছে উপহাসের মতো লাগে। ঠগের জীবনে মায়া মমতার, বিশ্বাসের স্থান নেই। মা ভবানীর সন্তান ও। পার্থিব কিছুতেই দুর্বলতা নেই ওর। সত্যিই কি নেই? কেন এখনো ঝিরণী উঠে নি? সে কি ভবানীর আদেশ অমান্য করছে? ভবানীর আক্রোশে পড়তে চায় না সে। 

কী ভাবছ, কাকা?”

কিছু না রে, মা।”

আচ্ছা কাকা, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমি বাবার কাছে যাব, আমাকে নিয়ে চলো।”

সে তো আমি বলতে পারব না, মা। তোমার হরিশ কাকা পারবে।”

আমার হরিশ কাকাকে লাগবে না, আমার তোমাকে লাগবে, কাকা। তুমি আমার সাথে চলো না, আমাকে প্রতি রাতে গল্প শোনাবে।”

 

সেই রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত গান-বাজনা হলো। সবাই পেটপুরে খেয়ে নদীর ধারে গাছের নিচে আগুন জ্বালিয়ে বসেছে আড্ডা দিতে, গল্পগুজব করে রাত কাটবে। নবণী ফিরিঙ্গিয়ার কোলে, হরিশ আর তার সাথীরা মুসাফিরদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা। কে যেন উচ্চৈঃস্বরে গান ধরল। সবাই মন দিয়ে শুনছে, মাথা দোলাচ্ছে। নবণী ফিরিঙ্গিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাতের খোলা আকাশ দেখছে হা করে। গানের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। হরিশরা টের পেল না যে সবাই কেমন যেন গোল হয়ে ধীরে ধীরে হরিশদের ঘেরাও করে বসছে। হঠাৎ গানের তালের সাথে ফিরিঙ্গিয়ার ভরাট গলা শোনা গেল, “তামাকু লেও।”

কিছু বুঝে উঠার আগে হরিশের পেছন থেকে কেউ ওর গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরল। পরপর সাতটি দেহ মাটিতে পড়ে গেল। ফিরিঙ্গীয়া তখনো চুপচাপ বসে আছে, নবণীর নিথর দেহ কোলে নিয়ে। কখনো খুন করতে হাত কাঁপত না তার, আজো কাঁপে নি। নবণীর নিথর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠল সে। সেই হাসির শব্দে কিছু শকুন উড়ে গেল গাছের উপর থেকে।

 


মুহাইমিনুল নাফিউ নিজেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসের সমুদ্রে ঝড়ে আটকে পড়া, সব হারানো কিন্তু হার না মানা বুড়ো এক নাবিকের মতো মনে করে।

Share this Article
Leave a comment