মূল লেখক: তারা ক্যাম্পবেল
অনুবাদক: তানজিনা তাবাস্সুম নোভা
“আকাশের রঙ নীল কেন?” তুমি প্রশ্ন করলে।
বেশ, উত্তরটি কে দিচ্ছে তার উপরেই সবকিছু নির্ভর করে।
তুমি যদি কোন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে এটি জিজ্ঞেস করো, তবে খুব সম্ভবত আলো সম্পর্কিত উত্তর পাবে। আলো কীভাবে বায়ুকণাতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, কীভাবে কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য (অর্থাৎ রঙ) শোষিত হয়, কীভাবে কিছু নির্দিষ্ট রঙ (অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য) ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসে, আর সেই নির্দিষ্ট রঙ/তরঙ্গদৈর্ঘ্যই (অর্থাৎ নীল) হলো যা তুমি আর আমি দেখতে পাই।
আবার, যদি তুমি কোন বিজ্ঞানীর কাছে জানতে চাও, তবে সম্ভবত একই উত্তরের আরো গোলমেলে কিন্তু অধিক বিশ্বাসযোগ্য একটি বর্ণনা পাবে।
কিন্তু যদি তুমি একজন লেখককে জিজ্ঞেস করো, তাহলে প্রতিবার তুমি ভিন্ন একটি উত্তর পাবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি উত্তর আছে নীল ফিঙ্গার-পেইন্টের বৈশিষ্ট্যের মাঝে। যখনই বাচ্চারা নীল রঙ ব্যবহার করে, এর ক্ষুদ্র কিছু অণু তাদের হাত থেকে বাতাসে মিশে গিয়ে একে নীল রঙে রাঙিয়ে তোলে। সময়ের সাথে এই রঞ্জক ম্লান হয়ে আসে, তবু যতদিন ফিঙ্গার-পেইন্টের ব্যবহার থাকবে, ততদিন নীল আকাশও থাকবে।
আছে আরো একটি প্রতিভাষ, যেটি উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বসবাসকারী নীলচোখা প্রাণীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তারা সারাক্ষণ উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর তাদের চোখের নীল রঙ আকাশের বুকে প্রতিফলিত হয়ে সারা পৃথিবীকে নীল আকাশ দেখার সুযোগ করে দেয়। মেরু অঞ্চলের এই প্রাণীদের কথা তুমি হয়তো এর আগে কখনও শুনো নি, কারণ তারা স্যাটেলাইট আর অভিযাত্রীদের থেকে লুকিয়ে থাকার কৌশল জানে। নীল চোখের এই প্রতিফলন বাদে তাদের আর কিছু দেখার সুযোগ আমাদের কখনোই হবে না।
তবে এই মুহূর্তে যে উত্তরটি আমার ঠিক বলে মনে হচ্ছে, তার সাথে দেবদূতদের এবং ব্লুবেরির সম্পর্ক আছে। ব্লুবেরি হলো দেবদূতদের প্রিয় খাবার, বুঝলে? অন্য কোনো খাবার খেতে তাঁরা এর চাইতে বেশি পছন্দ করেন না; একইসাথে বেরি স্বাস্থ্যকর, কাজেই এটিকে একটি আনন্দময় কাকতাল বলা যায়। একমাত্র সমস্যা হলো, দেবদূতেরা খাওয়ার ব্যাপারে বেশ অগোছালো, এবং তাঁরা প্রায় সারা দিনব্যাপী খেতেই থাকেন। হ্যাঁ, বীণা বাজানো, গান গাওয়া, আর ছোট বাচ্চাদের বেসিনের নিচে রাখা ব্লিচে হাত দেওয়া থেকে বিরত রাখা—এসব কাজও তাঁরা অবশ্যই করেন। কিন্তু যেহেতু তাঁরা অনন্তকাল বেঁচে থাকেন, সেহেতু ব্লুবেরি চাবানোর জন্য যথেষ্ট সময় সর্বদাই তাঁদের হাতে থাকে। ফলে ব্লুবেরির ছোট ছোট অবশিষ্টাংশ ছড়িয়ে পড়ে সারা আকাশ জুড়ে।
আরো বাজে ব্যাপার হচ্ছে, দেবদূতদের কেউ কেউ আবার ব্লুবেরির খোসা পছন্দ করেন না। তাই প্রতিটি বেরি খাওয়ার আগে তাঁরা খোসা ছাড়িয়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেন। তবে এ কারণে তাঁদের উদাসীন ও পরিবেশ নোংরাকারী ভাবাটা অবশ্য ঠিক হবে না। তাঁরা জানেন, যে ঐ খোসাগুলো তাঁরা ঠিকই পরিষ্কার করে ফেলবেন; শুধু ঐ মুহূর্তেই তাঁরা সেটা করেন না, এই যা।
এভাবে দিন যত গড়ায়, দেবদূতেরা তত বেশি বেরি খান। আর যখন সূর্য ডুবে যায়, বেরির মণ্ড ও রসের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি হয় অপূর্ব লাল, কমলা ও হলুদ রঙ। এদিকে দেবদূতেরা খেতেই থাকেন, আর বেরির নীল খোসা আর ছোট ছোট টুকরো দিয়ে আকাশের রঙ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। চাঁদ-তারার জন্য অল্প কিছু ফাঁকা জায়গা ছাড়া যতক্ষণ পর্যন্ত না পৃথিবীতে আলো পৌঁছানোর আর কোনো সুযোগ থাকে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা বেরি চিবোতেই থাকেন। সত্যি বলতে কী, এর ফলে বেশিরভাগ সময়ই চাঁদের জন্যও যথেষ্ট জায়গা থাকে না, সেজন্যই পুরো মাসে শুধুমাত্র একবার আমরা সম্পূর্ণ চাঁদটিকে দেখতে পাই।
অবশেষে মাঝরাতে ঈশ্বর দেখতে পান যে, যথেষ্ট হয়ে গেছে; তখন এই জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য তিনি দেবদূতদের আদেশ দেন। নিশ্চয়ই তাঁরা সাথে সাথে কাজে লেগে পড়েন, তবুও এই বিশাল অগোছালো অবস্থা পরিষ্কার করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। যখন তাঁরা পরিষ্কার করা শুরু করেন, ব্লুবেরির জঞ্জালের স্তূপ ভেদ করে ধীরে ধীরে আলোকে উঁকি মারতে দেখা যায়। এই ধোয়া-মোছা করতে করতেই পৃথিবীতে ভোর শুরু হয়, আর যখন তাঁরা পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসতে পারার মতো যথেষ্ট ব্লুবেরি পরিষ্কার করে ফেলেন, তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে দিনের আলো।
তবে একটি সমস্যা হচ্ছে, ব্লুবেরির খোসা থেকে খুব সহজেই দাগ লেগে যায়, আর দেবদূতেরা সেই দাগ পুরোপুরি তুলে ফেলতে পারেন না। কোন কোন দিন তাঁরা মোটামুটি ভালোভাবেই কাজটি করতে পারেন, আর সেসব দিনে আকাশের রঙ থাকে হালকা নীল। তবে এই দাগের ব্যাপ্তি তুমি বুঝতে পারবে খুব রৌদ্রোজ্জ্বল কোন দিনে, যখন আকাশের রঙ গাঢ় নীল থাকে। এই দাগ নিয়ে ঈশ্বরের অবশ্য তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। আসলে, এই দাগগুলো তাঁর চমৎকার লাগে। আর পৃথিবীতে তাঁর ভাড়াটিয়ারাও এ নিয়ে কিছু মনে করে না। শীঘ্রই অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও তাঁর নেই, কাজেই সম্পত্তির পুনর্বিক্রয় মূল্য নিয়েও তাঁকে আপাতত চিন্তা করতে হচ্ছে না। দেবদূতেরা তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, এটিই ঈশ্বরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তুমি হয়তো ভাবতে পারো, দেবদূতেরা ব্লুবেরি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেলে কী হবে? তাঁরা যদি ব্লুবেরি ফেলে রাস্পবেরি খাওয়া শুরু করে দেন, তখন কী হবে? তখন কি ধীরে ধীরে আকাশের রঙ বেগুনি হয়ে উঠবে? তাঁরা যদি কলা খেতে শুরু করেন, তাহলে হলুদ খোসাগুলো কি আকাশকে সবুজ করে তুলবে? অথবা তাঁদের যদি লেবু ভালো লাগতে শুরু করে, তাহলে কি লেবুর রস আকাশকে ধুয়ে তাকে চিরতরে বর্ণহীন করে দেবে? এমন যদি হয়, তাহলে তোমার নাতি-নাতনিরা কি কখনও আদৌ বিশ্বাস করবে যে, কোনো এক সময় আকাশের রঙ নীল ছিল?
নাকি তারা ধরে নিবে যে তুমি শুধুই দেবদূত আর ব্লুবেরি নিয়ে গল্প ফাঁদা একজন বোকা লেখক?
Tanzina Tabassum Nova is a full-time couch-potato, and a part-time reader, writer, translator, and reciter.