আদনান সহিদ
প্রিয়তমেষু,
বাদল দিনের দ্বিতীয় কদমফুলের শুভেচ্ছা। কেমন হচ্ছে আপনার বৃষ্টিবিলাস?
আটটি অয়োময় বছর পার হলো, পার হয়ে গেল কত শ্রাবণ মেঘের দিন, কত রজনী, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ন, রোদনভরা বসন্ত কিংবা নক্ষত্রের রাত! সেইসব দিন রাত্রির কথা কি মনে পড়ে যখন মীরার গ্রামের বাড়িতে ময়ূরাক্ষী নদীর রূপালী দ্বীপটায় চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক (শুভ্র, হিমু, অনীশ), রূপা, লীলাবতী, নবনী, রুমালী, মৃন্ময়ী, পিপলী বেগম, কুটু মিয়া, আসমানীরা তিন বোন, নলিনী বাবু BSc, মিসির আলি সাহেব, আমি এবং আমরা সবাই লিলুয়া বাতাসে নীলপদ্ম হাতে জোছনা ও জননীর গল্প শুনতাম?
দিনের শেষে উঠান পেরিয়ে দুই পা এগিয়ে তেঁতুল বনে জোছনা আজও দেখি ঠিকই তবুও চোখে আমার তৃষ্ণা রয়েই যায়। আজও আপনার বিরহগাঁথায় মনে হয় পায়ের তলায় খড়ম নেই!
যা হোক, এদিককার খবর বলি। আজ চিত্রার বিয়ে। মা বললেন, “আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ।”
আমি বললাম, “আজ আমি কোথাও যাব না। জনম জনমের নির্বাসনে থাকব আমার আপন আঁধারে। ভালোবেসে যদি সুখ নাই–ই থাকে তবে মেঘের ছায়া কিংবা বৃষ্টি ও মেঘমালার বাসরকে সাক্ষী রেখে বলব না, ‘এসো কর স্নান।’
মনে রাখব না কিছুতেই যে তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। স্বপ্ন ও অন্যান্য সৌরভের দেয়ালে শোভা পাবে না আমার পেন্সিলে আঁকা পরী। আকাশ জোড়া মেঘে বন বাতাসী শ্যামল ছায়ায় বসে কবি ছুঁয়ে দেখবে না তার নীল অপরাজিতা বরং কোন এক চৈত্রের দ্বিতীয় দিবসে মহাপুরুষের প্রিয় পদরেখা খুঁজতে খুঁজতে এই আমি হয়ে যাব এক দারুচিনি দ্বীপের বাসিন্দা। সেখানে আমি এবং কয়েকটি প্রজাপ্রতি মিলে হেসেখেলে দিন কাটিয়ে দেব। মাঝে মাঝে তন্দ্রাবিলাস থেকে জোর করে উঠিয়ে জলকন্যারা হরতন ইশকাপনের টেক্কা তুলে দেবে আমার এলেবেলে সমুদ্র বিলাসে। তোমাদের এই নগরে সম্রাট কিংবা রাজার কুমার নিনিতের মতো তোমাদের জন্য রূপকথা হয়ে থাকবে আমার অদ্ভুত সব গল্প!”
“এ কী কাণ্ড! ছেলেটা এসব কী উদ্ভট গল্প করছে!” সবিস্ময়ে ভাবতে ভাবতে মা বাসার সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন চিত্রার বিয়ের নিমন্ত্রণে।
সন্ধ্যা নামল। যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, তখন আমরা কেউ বাসায় নেই। শুধু আমি কিছুক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে দীঘির পাড়ে জল জোছনা দেখছিলাম। হঠাৎ মনে হলো—দিঘির জলে কার ছায়া গো? ভুল দেখলাম? পরক্ষণেই মনে হলো আসলে আমার দেখা না দেখায় কিছু আসে যায় না। আজ কোথাও কেউ নেই আমার, আমিই পাখি—আমার একলা পাখি! ভুল বললাম—এখন আমার আছে জল। একসময় ছিলেন আপনি আর আপনার আনন্দ–বেদনার কাব্য।
আচ্ছা বাদশাহ নামদার, হঠাৎ কোথায় চলে গেলেন বলেন তো? অভ্যাসবশত সেদিন হোটেল গ্রেভার ইনে ফোন দিয়ে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না! অন্যদিনের মতই রিসেপশনিস্টের সাথে একটু খোশগল্পে মেতে উঠে জানলাম নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ নাকি এখন! কেবল আপনিই কি গৃহত্যাগী জোছনার খোঁজে বের হয়ে যশোহা বৃক্ষের দেশে ‘বনের রাজার মতো’ নীল হাতি, বোতল ভূত, রাক্ষস, খোক্ষস এবং ভোক্ষস, হলুদ পরী, নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ সাথে নিয়ে রূপার পালঙ্কে বসে ছবি বানানোর গল্প কিংবা শীত ও অন্যান্য গল্পে মজেছেন? এই বিশ্বাসে আপনার খোঁজে শুভ্র গেছে বনে। এদিকে মৃন্ময়ীর মনও ভালো নেই। আর সানাউল্লার তো মহাবিপদ! সে প্রায়ই স্বপ্নে আপনাকে দেখে, আপনার কথা শুনতে পায় আর ঘুমের মধ্যে বলে ওঠে, “কে কথা কয়?” সব দেখে কহেন কবি কালিদাস, “এ যেন দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই।”
এসব কি কেবলই এক কুহক? নাকি নয় নম্বর বিপদ সংকেত? দূরে কোথাও অচিনপুরের শঙ্খনীল কারাগারে আপনাকে বন্দি করে নি তো কোনো কালো যাদুকর? নাকি অন্যভুবনের আয়না ঘরে ভয়ংকর ভুতুড়ে কোনো কানী ডাইনী শুনাচ্ছে আপনাকে অন্ধকারের গান? এই মেঘ, রৌদ্রছায়া, চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস, এই বসন্ত, মাতাল হাওয়া কি আর টানছে না আপনাকে একজন মায়াবতী কিংবা পরীর মেয়ে মেঘবতীর মতো? চলে যায় বসন্তের দিন। আপনি বিনা মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্যের কূল কিনারাও আর হচ্ছে না। কে দেবে তার ধাঁধার জবাব? হিজিবিজি চিন্তায় পুরাই বাঘবন্দি এখন মিসির আলি!
প্রিয় ম্যাজিক মুন্সী, শুনেন।
আমাদের সাদা বাড়ির দরজার ওপাশে সযত্নে রেখেছি আপনার প্রিয় লেখার সরঞ্জামগুলো—বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেইন পেন, রং পেন্সিল। লিখবেন না আর নিশিকাব্য, বৃক্ষকথা? লিখবেন কিছু শৈশব–গৌরীপুর জংশন, ইস্টিশন, জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল, একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখির আখ্যান? কাক ও কাঠগোলাপের গল্প? নাকি মেঘের উপর বাড়িতে নন্দিত নরকে বসেই লিখতে থাকবেন আরো বই?
আপনার মতো দ্বিতীয় মানব খুঁজে পাই নি এখনও। আসলে খুঁজতে চাইও না আর। তবে কি থাকব আপনার অপেক্ষার অনন্ত অম্বরে? অনন্ত নক্ষত্র বীথির পানে চেয়ে? নাকি তিথির নীল তোয়ালে দিয়ে আরেকটিবার মুছে দেখব মে ফ্লাওয়ার সজ্জিত এপিটাফ যেখানে লিখেছেন:
“সকল কাঁটা ধন্য করে তোমাদের জন্য ভালোবাসা।”
পুনশ্চঃ প্রিয় পাঠক ! বলুন তো, এই চিঠিতে হুমায়ূন আহমেদের কতগুলো উপন্যাস আছে?
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তার অকৃত্রিম বন্ধু, তার হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তাঁর বিশ্বাস।